গাজীপুর সিটি করপোরেশনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের বাড়ি টঙ্গীর আউচপাড়ায়। গত মঙ্গলবার এ বাড়ির নিচতলার বিশাল কক্ষটিতে চলছিল সভা। টঙ্গীর ১৫টি ওয়ার্ডের বিএনপির ও এর অঙ্গ-সংগঠনের নেতাদের নিয়ে সভা চলল প্রায় দুই ঘণ্টা। সভার শুরুতে থাকলেও পরে নির্বাচনী প্রচারে বেরিয়ে গেলেন হাসান সরকার।
টঙ্গীর চেরাগ আলীতে বিএনপির কার্যালয়। তবে আউচপাড়ার সরকারবাড়িটি এখন বিএনপির সমস্ত কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। বাড়ির পেছনে শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। সেখানে এসে বসেন নেতা-কর্মীরা। একদিন হাসান সরকার কথাপ্রসঙ্গে বলছিলেন, ‘পার্টি অফিসে একাধিকবার ঝামেলা করেছে পুলিশ। তারপর থেকে এখানেই কর্মকাণ্ড হয়।’
সরকারবাড়িতে সভা শেষ হলো বেলা ১১টার দিকে। বেরিয়ে এলেন ওয়ার্ডপর্যায়ের নেতারা। ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীর পোস্টার এবং লিফলেট তাঁদের হাতে। কেউ রিকশায়, কেউ অটোরিকশায় বান্ডিল করা পোস্টার নিয়ে যাচ্ছেন। সভা থেকে বেরিয়ে এলেন গাজীপুর জেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ সাংগঠনিক সম্পাদক সালাউদ্দিন সরকার। হাসান সরকারের মেয়র নির্বাচনে টঙ্গীর দায়িত্বে আছেন তিনিই। নেতা বের হয়ে আসতেই অপেক্ষমাণ অনেকেই ঘিরে ধরেন। এক কর্মী বিএনপি-সমর্থিত এক কাউন্সিলর প্রার্থীর বিরুদ্ধে অনুযোগের সুরে বললেন, ‘সে তো নিজের ভোট নিয়া ব্যস্ত। ধানের শীষ নিয়া একটা কথা কয় না। টঙ্গীতে যদি এই অবস্থা হয়, তাইলে অন্য জায়গায় কী হইব কন?’ সালাউদ্দিন সরকার আশ্বস্ত করেন কর্মীকে। নিজে ওই কাউন্সিলর প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানালেন।
তিন দিন আগে প্রচার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলেও আজ সভা কেন? উত্তরে সালাউদ্দিন সরকার বলেন, ‘এক মাস পর প্রচার শুরু। মাঝে সব সময় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ থেকেছে। তবে একটু তো গতি কমেছেই। সে জন্য আবার সবাইকে জড়ো করলাম। টঙ্গীর মতো এলাকা। এখানে প্রচারে তো কৌশলী হতে হবে।’
টঙ্গীতে তাহলে বিশেষ নজরদারি আছে—এ প্রশ্নের জবাবে শ্রমিক দলের গাজীপুর জেলার সভাপতি সালাউদ্দিন সরকারের বক্তব্য, ‘ভোটার বেশি, এলাকা বড়, শ্রমিক অঞ্চল। নানা মতের, নানা পদের মানুষ। এখানে বিশেষ নজর তো সবারই থাকবে।’
টঙ্গীতে এই ‘বিশেষ নজর’ কি এর ভোটসংখ্যার দিকে তাকিয়েই? ভোটের অঙ্ক কিন্তু সেই কথাই বলে।
পুরো গাজীপুরকে মোট আটটি বিশেষ অঞ্চলে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে আছে কাশিমপুর, কোনাবাড়ী, বাসন, কাউলতিয়া, গাজীপুর পৌর এলাকা, গাছা, পুবাইল ও টঙ্গী। গাজীপুর সিটির মোট ভোটার সংখ্যা ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৬। এর মধ্যে ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৯৫২ ভোটারই টঙ্গীর। অর্থাৎ মোট ভোটারের ৩২ শতাংশ টঙ্গীর। বাকি সাত অঞ্চলের কোনোটিরই ভোটার দেড় লাখও পার হয় না।
টঙ্গীতে ভালো করলে নির্বাচনে ভালো হবে—এ বিশ্বাস শুধু বিএনপির নয়, আওয়ামী লীগেরও আছে। এলাকাটিতে বিশেষ নজর আছে শাসক দলেরও।
টঙ্গী তল্লাটে, বিশেষ করে স্থানীয় সরকার পরিষদে, সরকার পরিবারের প্রভাব সব সময় ছিল। টঙ্গী পৌরসভা হওয়ার পর এর প্রথম চেয়ারম্যান হন এবারে বিএনপির প্রার্থী হাসান সরকার। পরেরবারও তিনি চেয়ারম্যান হন। এরপর একাধিক নির্বাচনে তাঁর চাচা ও চাচাতো ভাই পৌরসভায় নির্বাচিত হন। পৌরসভা সরকার পরিবারমুক্ত করেন এ পৌরসভার তিনবারের চেয়ারম্যান ও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা আজমতউল্ল্যা খান। গাজীপুর সিটিতে পরিণত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এর মেয়র ছিলেন। সরকার পরিবার দীর্ঘদিন ধরে টঙ্গীর স্থানীয় সরকার পরিষদে নেই। তবে তারপরও তাদের একটি প্রভাব যে এলাকায় আছে, তা স্বীকার করেন আজমতউল্ল্যা খানও। তবে তাঁর কথা হলো, টঙ্গী পৌরসভায় তিনি সরকার পরিবারের বিরুদ্ধে বারবার বিজয়ী হয়েছেন। এখানে আওয়ামী লীগের অবস্থান শক্তিশালী। প্রতীকের এ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর প্রতীক ‘নৌকা’ অবশ্যই সুবিধা পাবে।
আওয়ামী লীগ টঙ্গীতে ‘বাড়ি বাড়ি’ গিয়ে ভোট চাওয়ার নির্বাচনী কৌশল বেছে নিয়েছে বলে জানান আজমতউল্ল্যা খান। এ ছাড়া উঠান বৈঠকের মতো বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
বিএনপি এবং এর প্রতিটি অঙ্গ-সংগঠনের নেতা-কর্মীকে টঙ্গীর ‘ঘরে ঘরে’ গিয়ে ভোট চাওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে বলে জানান সালাউদ্দিন সরকার।
বিএনপির প্রার্থী হাসান সরকারের বাড়ি টঙ্গীতে। এ অঞ্চলে বিএনপির একাধিক নির্বাচনী পথসভায় বিষয়টি বলতে শুনেছি বক্তাদের। বিএনপি মনে করছে, এর একটি সুবিধা তারা পাবে। টঙ্গী থানা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বলছিলেন, ‘এলাকার মানুষ হিসেবে হাসান সরকার সুবিধা পাবেন, এটাই স্বাভাবিক।’
তবে মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা আসাদুর রহমান অবশ্য বলেন, ‘দলভিত্তিক নির্বাচনে আঞ্চলিকতার কোনো সুবিধা পাবেন না বিএনপির প্রার্থী।’
তুরাগের পাড়ে গড়ে ওঠা শিল্প শহর টঙ্গীর জনসংখ্যার বড় অংশ এখানকার স্থানীয় নয়। এরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জীবিকার সন্ধানে এসে এখানে স্থায়ী হয়ে যাওয়া মানুষ। নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের গাজীপুর মহানগর শাখার সভাপতি মনিরুল ইসলাম রাজীব বলছিলেন, ‘এখন আমরা যারা এখানকার আদি বাসিন্দা, তাদের সংখ্যাই কিন্তু কম। এখানে যেসব মানুষ এসে নতুন করে বসতি গড়ে তুলেছেন, তাঁদের কাছে আঞ্চলিকতা বলে কোনো বিষয় নেই। এঁরা প্রার্থীদের দক্ষতা ও যোগ্যতা দেখেই ভোট দেবেন বলে আমার ধারণা।’